হিসাববিজ্ঞান মানুষের মূল্যবােধ ও জবাবদিহিতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে-প্রতিবেদন-(লিখনে-মোহাম্মদ ইরফান)
ভূমিকাঃ মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ তাই সহজে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে পারে। অর্থাৎ সমাজবদ্ধভাবে
বসবাস করার ফলে তাদের মধ্যে সেবার আদান প্রদান শুরু হয়। তাই সেবা যখন অর্থের মাধ্যমে আদান প্রদান
হতে থাকে তখন এই হিসাব নিকাশের প্রয়ােজন হয়। এজন্য বলা হয়, হিসাববিজ্ঞানের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের
মতােই পুরাতন। মানুষের জীবন যত বৈচিত্রময় হয়ে উঠেছে, তেমনি হিসাববিজ্ঞানের প্রয়ােজনও অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
মানুষের জীবনে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক ঘটনা ঘটতে পারে, সেগুলােকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে সংরক্ষণ না করা হলে, সঠিক
ফলাফল বুঝতে পারা যায়। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে কিছু আর্থিক ঘটনা এবং কিছু অনার্থিক
ঘটনা। যে সকল আর্থিক ঘটনাগুলাের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে সেগুলাের উপর
গুরুত্ব আরােপ করা হয় বেশী।
হিসাববিজ্ঞানের ধারণাঃ হিসাববিজ্ঞান এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের যাবতীয়
আর্থিক কার্যাবলি যেমন- খরচ পরিশােধ, আয় আদায়, সম্পদ ক্রয় ও বিক্রয়, পণ্য ক্রয় ও বিক্রয়, দেনাদার
হতে আদায় এবং পাওনাদারকে পরিশােধ ইত্যাদি হিসাবের বইতে সুষ্ঠুভাবে লিপিবদ্ধ করা যায় এবং নির্দিষ্ট
সময় শেষে আর্থিক কার্যাবলির ফলাফল জানা যায়। হিসাববিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবসায়ের আর্থিক লেনদেন লিপিবদ্ধকরণ,
শ্রেণিবদ্ধকরণ, ব্যাখ্যাকরণের পদ্ধতি আলােচনা করা হয়। এর ফলে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থার
পরিবর্তন নির্ণয় করা যাবে এবং এসব তথ্যাবলি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে।
হিসাববিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করে হিসাবের বিভিন্ন বিবরণী ও প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়, যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের
আর্থিক অবস্থা জানা যায়। তাইহিসাববিজ্ঞানকে ব্যবসায়ের ভাষা' বলা হয়।
হিসাববিজ্ঞানের উদ্দেশ্যঃ লেনদেনসমূহ সঠিকভাবে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধকরণ ব্যতীত প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ফলাফল ও
আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। তাই হিসাববিজ্ঞানের প্রথম উদ্দেশ্য লেনদেনসমূহকে সুনির্দিষ্ট
পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিকভাবে হিসাবের বইতে লিপিবদ্ধ করা। হিসাববিজ্ঞানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য আর্থিক ফলাফল ও আর্থিক অবস্থা নিরূপণ করা। লাভ-ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের মাধ্যমে ব্যবসায়ের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব। যাবতীয়
আয় ও ব্যয় সঠিকভাবে লিপিবদ্ধকরণের মাধ্যমে ব্যবসায়ের লাভ-ক্ষতি নির্ণয় করা সম্ভব। প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, দায় ও মালিকানা স্বত্বের পরিমাণ নির্ণয়ের মাধ্যমে আর্থিক অবস্থা
সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করা সম্ভব। বিভিন্ন সেবামূলক অমুনাফাভােগী প্রতিষ্ঠান যেমন- স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ক্লাব ও সােসাইটিতে
বিভিন্ন উৎস হতে অর্থের আগমন ও বহির্গমনের পরিমাণ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে নির্দিষ্ট সময়ান্তে
এ সকল প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন হিসাবে উদ্বৃত্ত নির্ণয় করা যায়। সরকার বিভিন্ন উৎস হতে কর, শুল্ক, ভ্যাট ধার্যের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় করে এবং বিভিন্ন
নিয়মিত ও উন্নয়নমূলক খাতে ব্যয় করে। সরকারের এসকল কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য হিসাববিজ্ঞান
সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
সমাজ ও পরিবেশের সাথে হিসাব্যবস্থার সম্পর্ক : হিসাববিজ্ঞান শুধু মুনাফা নির্ণয়ের জন্যই ব্যবহার করা হয় না। মুনাফা নির্ণয়ের পাশাপাশি
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান
কর্তৃক সমাজ এবং পরিবেশেরও যাতে কোনাে রকম ক্ষতি না হয়, হিসাববিজ্ঞান সেদিকটিতেও অবদান
রাখে। নিচের উদাত্মণগুলাে থেকে সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে হিসাববিজ্ঞানের করণীয় বুঝা যাবে।
১. জলবায়ুদূষণ রােধে প্রতিষ্ঠান কিছু অর্থ খরচ করবে এবং হিসাবরক্ষক তার হিসাব রাখবে এবং সে হিসাব থেকে বুঝা যাবে ব্যবসার মালিক সমাজ এবং পরিবেশ সম্পর্কে কতটুকু সজাগ। বিশেষ করে তেল কোম্পানিগুলাে বায়ুদূষণ রোধে অনেক ব্যয় করে থাকে।
২. শিল্প-কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। ব্যবসায়ের মালিক ও হিসাব্রক্ষককে এর প্রতিরােধে অর্থ খরচ করতে হয়, হিসাব রাখতে হয় এবং এ বিষয়ে সরকারের নিয়মনীতিকে অনুসরণ করে চলতে হয়।
হিসাববিজ্ঞানের উৎপত্তিঃ সভ্যতার সূচনা হতে মানুষ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বা হিসাব গাছের গায়ে, গুহায় বা
পাথরে চিহ্ন দিয়ে রাখত। এক সময় মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করল এবং কৃষিকাজ আরম্ভ করল। ঘরে দাগ কেটে এবং
রশিতে গিঁট দিয়ে ফসল ও মজুদের হিসাব রাখা শিখল। আস্তে আস্তে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়,
সমাজ বিস্তার লাভ করে, বিনিময় প্রথা চালু হয়, মুদ্রার প্রচলন হয় এবং ব্যবসায়-বাণিজ্য শুরু হয়। ক্রয়-বিক্রয়,
জমা-খরচ, দেনা- পাওনা এবং অন্যান্য লেনদেন হিসাৱে বইতে অঙ্কের মাধ্যমে লেখা শুরু হয়। ১৪৯৪ খ্রিষ্টাব্দে
লুকা প্যাসিওলি নামে একজন ইতালীয় গণিতবিদ সুম্মা ডি এরিথমেটিকা জিওমেট্রিয়া প্রপােরশনিয়েট প্রপােরশনালিটা’ নামে একটি গ্রন্থ লিখেন এবং এতে হিসাবরক্ষণের মূল নীতি “দুতরফা দাখিলা
(Double Entry)” ব্যাখ্যা সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যের অগ্রগতি হয়
এবং এরই ফলে হিসাববিজ্ঞানেরও উন্নতি হয়। ব্যবসায় যেমন ছােট থেকে বড় হতে থাকে তেমনি এর পরিধিও
বৃদ্ধি পেতে থাকে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি ব্যবসায়ী, অব্যবসায়ী, সরকারি, বেসরকারি, মুনাফাভােগী
ও অমুনাফাভােগী সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানে হিসাববিজ্ঞানের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
হিসাববিজ্ঞান ও মুল্যবােধ - মূল্যবােধ হলাে ব্যক্তি ও সমাজের চিন্তা চেতনা, বিশ্বাস, ধ্যান ধারণা প্রভৃতির সমন্বয়ে
দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা একটি মানদণ্ড, যার দ্বারা মানুষ কোনাে বিষয়ের ভালাে-মন্দ বিচার করে ভালােকে গ্রহণ
ও মন্দকে বর্জন করে। নিচে মূল্যবোেধ সৃষ্টিতে হিসাববিজ্ঞান কীভাবে সহায়তা করে তা ব্যাখ্যা করা হলাে-
১. সততা ও দায়িত্ববােধের বিকাশ : হিসাবরক্ষণের ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের রীতি-নীতি
ও কলাকৌশল
যথাযথভাবে অনুসরণ করা হলে আর্থিক দুর্নীতি, জালিয়াতি, সম্পদ ইত্যাদির উপর নিয়ন্ত্রণ
থাকে এবং
হিসাবের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়। আর বছত্রের পর বছর এর অনুসরণের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও
দায়িত্ববােধ
বিকশিত হয়।
২. ঋণ পরিশোেধ সচেতনতা সৃষ্টি : হিসাববিজ্ঞান ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে ঋণ পরিশােধে সচেতনতা
সৃষ্টি
করে এবং তাদের মূল্যবােধ জাগ্রত করে। ফলে ঋণখেলাপি হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পায়।
৩. ধর্মীয় মূল্যবােধ সৃষ্টিসৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার এবং অপ্রয়ােজনীয়
ব্যয় পরিহার ধর্মীয়
মূল্যবােধের অংশ।
হিসাববিজ্ঞান ও জবাবদিহিতাঃ কোনাে কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট হলে কাজের ফলাফলের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে
তার কাজের জন্য দায়ী করা যায়। নিজের কাজের জন্য তৃতীয় পক্ষের নিকট দায়বদ্ধতাই জবাবদিহিতা। এই জবাবদিহিতা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে হিসাববিজ্ঞানের ভূমিকা উল্লেখ করা হলাে-
ক) ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা : আধুনিক বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থায়
আয়, ব্যয় ও বিনিয়ােগের জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তিগণকে পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়, যাতে করে দায়িত্বপালনে
পূর্ণ মনােযােগ প্রদান সম্ভব হয় এবং নির্দিষ্ট হিসাবকাল শেষে অর্পিত দায়িত্বের ফলাফল সম্পর্কে
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রশ্নের জবাব প্রদানেও সক্ষম হয়।
খ) মালিক, ঋণদাতা ও বিনিয়ােগকারীদের নিকট জবাবদিহিতা : প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষণ ও
ব্যবস্থাপনায় নিয়ােজিত ব্যক্তিবর্গের এই মর্মে জবাবদিহি করতে হয় যে প্রস্তুতকৃত বিবরণীতে প্রতিষ্ঠানের
সঠিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কি না, বিনিয়ােগকৃত অর্থের সঠিক ব্যবহার কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে,
অর্জিত মুনাফা ও প্রাক্কলিত মুনাফার সংগতি রক্ষা হয়েছে কি না ইত্যাদি। এরূপ জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে আর্থিক অনার্থিক সকল ক্ষেত্রে চরম বিশলা ও অবনতি পরিলক্ষিত হয়।
উপসংহারঃ সুতরাং হিসাববিজ্ঞান হচ্ছে, এমন একটি বাস্তব বিষয়, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বিধিবদ্ধ ও নিয়ম অনুসারে আর্থিক ফলাফল নির্ণয় করে এর স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এবং আগ্রহী পক্ষসমূহের নিকট তথ্য প্রকাশ করে। তাই আমরা বলি, বর্তমানে হিসাববিজ্ঞানের কার্যক্রম ও এর পরিধি দিনে দিনে বাস্তবভিত্তিক, আধুনিকভাবে প্রয়ােগ এবং উন্নতি উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
irfan171097.mi@gmail.com